Header Ads

Physics -11 (Chapter-05)  Part-1

প্রমিত ভাষার প্রয়োজন ও আঞ্চলিক ভাষার ভূমিকা

প্রমিত ভাষা হিসেবে একটি নির্দিষ্ট রূপ গ্রহণ করাকে কেউ কেউ ভাষার আধিপত্য বলে অভিহিত করছেন। তাদের দাবি আমাদের আঞ্চলিক ভাষাগুলোকে গ্রাহ্য করতে হবে। যেহেতু বেশিরভাগ মানুষ ‘প্রমিত’ ভাষায় নয়, আঞ্চলিক বুলিতে কথাবার্তা বলেন, অতএব প্রমিত সাধারণ মানুষের ভাষা নয়। ভাষা বিষয়ে তাদের এই গণমুখী চেতনাকে আমি শ্রদ্ধা জানাই। যে ভাষা মানুষ ব্যবহার করে না তা কখনোই টিকে থাকতে পারে না। পারেওনি। এই কারণে প্রমিতবিরোধীরা দাবি করছেন আঞ্চলিক বুলিকেই হয় প্রমিত রূপে গ্রহণ করতে হবে, নতুবা প্রমিত রূপের ধারণা থেকে সরে আসতে হবে যেহেতু এটি অন্যসব বুলির ওপর ছড়ি ঘুরাচ্ছে।
প্রশ্ন হল ভাষার যে প্রমিত রূপটি চালু আছে সেটাকে হটিয়ে তারা কোন অঞ্চলের বুলিটিকে প্রমিত রূপে দেখতে চান? ধরা যাক সিলেটের বুলিটিকেই কেউ একজন প্রস্তাব করলেন, তাহলে চট্টগ্রামের তারাও তো একই দাবি নিয়ে যৌক্তিক কারণেই হাজির হতে পারে। কিংবা কুমিল্লার, খুলনার, যশোরের, বরিশালের বুলি কী দোষ করেছে? তাদের দাবিরও তো ন্যায্যতা আছে। আঞ্চলিক বুলিবাদীরা এর সমাধান কীভাবে করবেন? নাকি এসব দাবি মেনে নিয়ে একটি মিশ্রভাষা তৈরি করবেন? মিশ্র ভাষার উদ্ভট ধারণাটি মনে হয় না তারা মেনে নেবেন। যদি মেনে নেন তাহলে এর সর্বজনমান্য রূপটি কিভাবে নির্ধারণ করবেন? তার ব্যাকরণই বা কী হবে? অর্থাৎ এই পথ আরও জটিল। এই দিকে বেশি দূর তারা যেতে পারবেন না। তাহলে অন্য যে বিকল্পটি থাকছে তাহলো কেউ কাউকে আধিপত্যের একত্ব না দিয়ে নিজেদের আঞ্চলিক বুলিতে বলবেন এবং লিখবেন। যদি এরকম ঘটে তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে এক অঞ্চলের মানুষ যখন অন্য অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইবেন তখন তারা কীভাবে সেটা করবেন? চট্টগ্রামের আঞ্চলিক বুলির সঙ্গে বরিশালের অধিবাসীদের যোগাযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। অতএব এই পথে যোগাযোগের সম্ভাবনা কম। যদি যোগাযোগ করতে হয় তখন ইন্টারপ্রেটার ব্যবহার করা ছাড়া উপায় থাকবে না। সুতরাং এই চিন্তা করাটা একেবারেই অবাস্তব হবে। হবে টাওয়ার অব ব্যাবেলের মতোই বহু ভাষার এক কিচিরমিচির যা পরস্পরকে ভাষিক একাকিত্বের মধ্যে নিক্ষেপ করবে। অতএব প্রমিত একটি ভাষিক রূপের প্রয়োজন হয় আমাদের সবার স্বার্থেই।
কিন্তু আঞ্চলিকতাপন্থীরা বাস্তব এই সমস্যাটিকে উপেক্ষা করছেন অনেকটা গায়ের জোরে। গায়ের জোরে এই অর্থে যে, সব নাগরিকের যোগাযোগের জন্য নয়, কেবল ‘চুক্তি আইন ও বৈদেশিক যোগাযোগের জন্য’ (ব্রাত্য রাইসু) প্রমিত ভাষার প্রয়োজন মনে করেন। এর বাইরে মানুষের অন্য যেসব বৃত্তি আছে তার প্রকাশে নাকি প্রমিত ভাষা অক্ষম। রাইসুর ভাষ্যমতে :
“মানুষের সংবেদন, অনুভূতি, ইচ্ছা, প্রতিক্রিয়া, কল্পনা, আধাত্মিকতা ইত্যাদি বহু জিনিসের ইচ্ছানিরপেক্ষ সম্মিলন হচ্ছে জীবিত মানুষের ভাষা। প্রমিত তার ধারে কাছেও নাই। এইটা হইল মানুষের ব্যবহৃত ভাষার অনুবাদ ও সংকোচন। অর্থাৎ বিকৃতি।”
অর্থাৎ রাইসু-কথিত উপরোক্ত অনুভূতিগুলো প্রকাশের সক্ষমতা নাকি প্রমিত ভাষার নেই। সেই সক্ষমতা কার আছে? ওটা নাকি আছে আঞ্চলিক ভাষার। প্রমিত ভাষা, তার কাছে, ‘অনুবাদ ও সংকোচন’। এবং প্রমিত ভাষার বিরুদ্ধে তার চূড়ান্ত ফতোয়া হচ্ছে এই ভাষা এক ধরনের ‘বিকৃতি’।
অন্য এক লেখায় প্রমিত ভাষার বিরুদ্ধে প্রায় রাইসুর নৈকট্য লাভ করে সোহেল হাসান গালিবের এই পর্যবেক্ষণ যে ‘প্রমিত ভাষা বস্তুত ভাষার কংকাল।’ আরেকটু এগিয়ে গালিব প্রমিত ভাষার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে আমাদেরকে অভিহিত করতে গিয়ে এও বলেন যে, ‘আমাদের প্রাত্যহিকতার যে ছন্দ-স্পন্দন, যেসব হেয়ালি ও হুল্লোড়, তর্ক ও তামাশা, আর যত আত্মময়তা, সব কনুই মেরে রাস্তায় ফেলে আসতে হয়। ফেলে আসার পর আমরা বুঝি আমার ‘আমি’টাকেই ছেড়ে এসেছি। তখন এ ভাষার মধ্যে যার কণ্ঠ শুনি সে তো আর আমি নই, অন্য কেউ।” গালিব প্রমিত ভাষায় নিজের কণ্ঠস্বর শুনতে পাবেন না আশঙ্কা করে প্রশ্ন তুলেছেন: “কিন্তু যে মনের কথাটি মনের মতো করে বলতে চায়, এই ভাষা দিয়ে তার কী ফায়দা!”
Add caption

সত্যিই তো যে ভাষায় আমি নিজেকে পরিপূর্ণরূপে প্রকাশ করতে পারব না, সে ভাষা দিয়ে আমি কী করব! মানুষ স্বভাবতই প্রকাশকামী এক সত্তা। সুতরাং ব্রাত্য রাইসু এবং সোহেল হাসান গালিবের উদ্বেগের সঙ্গে একাত্ম না হয়ে কোনো উপায় নেই।

No comments

Powered by Blogger.